আমাদের ভাড়া বাসাটা ছিল টিনের চালের , বর্ষায় পানি পড়ত ঝরঝর । তাতে রান্নাঘর ভেসে যেত । রান্নাঘরের হাউজের পাশে একটা গেট। গেটের ওপাশে দূষিত বাতাসে ভরপুর সরু নর্দমা। তারপাশে আকাশ ঢেকে দাঁড়ানো পাঁচ কী ছয়তলা বিল্ডিং।
তখন কৈশোর কাল। আমি বুভুক্ষের মত রোজ ভেতর ঘরের জানালা খুলে এক চিলতে আকাশ দেখার চেষ্টা করি। নর্দমার এক পাশে চেরি ফুলের গাছ। বসন্তে ফুলের ভারে মাথা নুয়ে একটা ডাল প্রায় জানালার কাছাকাছি এসে আমায় ডাকে। আমি জানালা গলিয়ে হাত বাড়াই, তৃষ্ণার্ত কৈশোর হাত। চেরি ফুলের সৌন্দর্য্যে বিমুগ্ধ চোখে অপার বিস্ময়।
সরু নর্দমা ঘেষে খেলাচ্ছলে ছুটে চলে একটা দুটো ইঁদুর । সামনে শ্যাওলা পড়া দালানের দেয়ালে মাশরুম গিজগিজ।
আমি সেসব কিছুই দেখিনা। আমি শুধু চেরি ফুল দেখি , আর চেরি ফুল ছুঁয়ে চূর্ণবিচূর্ণ রোদ বিছানায় কিভাবে একটু একটু করে মিলিয়ে যায় তাই দেখি। আর ছটফট করি একটু নীলাকাশ যদি পেতাম !
স্কুল থেকে ফিরেই একটা গল্পের বই নিয়ে জানালায় হেলান দিয়ে পড়তে বসে যাই। আম্মা বকে। “ভাত খেতে আয়।”
আমি না শোনার ভান করি । গোগ্রাসে গল্প গিলি। বই পড়তে পড়তে বিকেল গড়ায়। তখন বই বন্ধ করে আমি চেরী ফুল দেখি। বিকেলের আলো কী করে জানলার সামনের মস্ত দেয়ালটার গায়ে একটু একটু করে নিভে আসে তাই দেখি। কিন্তু কোন আকাশ দেখিনা।
বাসায় আলো বাতাস কম। ছাতা পড়া গন্ধ। টিনের চালে বৃষ্টির ঝমঝম শব্দ। রান্নাঘর ভেসে সয়লাব। ষাট পাওয়ারের টিমটিমে আলোয় বৃষ্টির পানি থেকে কোনমতে গা বাঁচিয়ে আম্মার রান্নাবান্না চলে। কারেন্ট চলে গেলে হারিকেন জ্বালানো হয় আমাদের কেরোসিনের সংসারে। স্টোভের চুলায় আম্মা ভাত রাঁধে। দশ মিনিট, পনেরো মিনিট, আধ ঘন্টা। একটু সন্ধ্যায় কাঠের ছাতা বগলদাবা করে আব্বা বাসায় ঢুকেন। হাতে একটা পাউরুটির প্যাকেট। ভাতের হাঁড়ি নামিয়ে আম্মা চায়ের পাতিল তুলেন। তারপর আমরা মেঝেতে গোল হয়ে বসে চা খাই। চা খাওয়ার ফাঁকে ফাঁকে আব্বা আম্মার মধ্যবিত্ত সাংসারিক আলাপ চলে। আব্বা চলে গেলে আম্মা ফের ভাত রাঁধতে বসেন । স্টোভের চুলার কালো ধোঁয়ায় আম্মার ফর্সা মুখে কালির দাগ। হারিকেনের স্বর্ণ আভায় আম্মার মুখ দেখতে দেখতে বৃষ্টির ছাঁটে অদ্ভুত সন্ধ্যা নামে। তারপর পড়াশোনার হারিকেনে তেল নেই , আমার পড়া হয়না। ভাইয়া বাসা থেকে বেরিয়ে যায় হুট করে। আপা বৃষ্টির পানিতে কলস ভরতে থাকে একটা র পর একটা। ছোট বোনটা ঘুমিয়ে যায় ঠান্ডা ঠান্ডা আবেশ ছড়ানো বিছানাতে। আর আমি বিষন্ন মুখ করে দরজার চৌকাঠে বসে থাকি। কাগজের নৌকা ভাসাই। বৃষ্টিতে পা ভিজে যায়। ভাল লাগে ,ভীষন ভাল লাগে।
মাঝে মাঝে বইয়ের পাতায় পাতায় একটু ভারাক্রান্ত চোখের আমার অবুঝ আম্মাকে দেখি। আর বৃষ্টিতে একাকার ঝুল রান্নাঘরটা ফিরে ফিরে আসে।
চেরি ফুল ফিরে আসে , আকাশ না দেখা বিকেল ফিরে আসে। আম্মার কড়া পড়া হাতে একটা চেরি ফুল । আজন্ম বৃষ্টিস্নাত অথচ আকাশ না দেখা চেরি ফুল।
