মাটির ব্যাংকটা কানের সামনে এনে আবার ঝাঁকায় বাবলু। ঝন ঝন ঝন।
আজকের কয়েনটা নিয়ে হবে পঁচাত্তরটা কয়েন।
বাবলু খুব ভালো ভাগ পারে। পঁচাত্তরকে চার দিয়ে ভাগ করলে সাঁইত্রিশ দশমিক পাঁচ হয়। বাবলু অনেক ভালো ভাগ পারে।
আজকে শুক্রবার। শুক্রবারে বাবার সাথে জুম্মার নামায পড়তে যেতে হয়। বাবলু বাবাকে ভয় পায়। বাবা মানুষগুলোর চোখ লাল হয়।
লাল চোখের দিকে তাকাতে হয়না। তাকালে চোখ পুড়ে যায়। মাটির দিকে তাকিয়ে কথা বলতে হয়। বাবলু মাটির দিকে তাকাতে পারেনা। বাবা মানুষটা ধমক দেয় , ” মাথা সোজা রাখতে পারিসনা, পাজি ছেলে!”
বাবলু আতংকিত হয়ে বাবার চোখে তাকায়। চোখদুটো টকটকে লাল। বাবলু ছুটে পালিয়ে যাওয়ার ইচ্ছেটা খুব কষ্টে সামলে রাখে।
সুযোগ পেলেই বাবা ওকে অংক কষায়। যেমন একটু আগেই বাবা জিজ্ঞেস করলেন
“বল্ তিন দুকুনে কত?”
বাবলু দুইয়ের নামতা পারে। খুব ভালো পারে।
কিন্তু তার দুই আর চার এলোমেলো হয়ে যায় ।
“বারো …”
বাবলু ভয়ে ভয়ে বলে। বাবা রেগে যায়। বাথরুম থেকে পানির পাইপটা নিয়ে আসে। পাইপটা বাবলুর পিঠে সপাং সপাং পড়ে। পড়তেই থাকে। পড়তেই থাকে। বাবলু চুপচাপ দাড়িয়ে থাকে দাঁতে দাঁত চেপে ,ঠোঁটে ঠোঁট চেপে।
দাঁতে ঠোঁট কামড়ে ধরে পা দিয়ে জমিন আঁকড়ে থাকে বাবলু। আর বাবলুর গোলাপি ঠোঁটদুটো নীল হয়ে যায়।
পাইপ হাতে ঘর্মাক্ত হয়ে বাবা বাথরুমে যায় গোসল করতে। ওর চোখে তখন লবণ-পানি জমে। এই পানিকে কান্না বলে। কাঁদলে শরীরে লবন পানির ঘাটতি হয়। সেই ঘাটতি পূরণ করতে ওরস্যালাইন খেতে হয়। বাবলু ঝাপসা চোখে রান্নাঘরে গিয়ে চিনি আর লবণের বয়াম হাতড়ায়। ওকে এখন ওরস্যালাইন বানাতে হবে।
বাবলু প্রচুর মার খেতে পারে।
চুপচাপ মার খায়। বাবলুকে তাই সবাই মারে। বাবা মারে, স্কুলের স্যাররা মারে, স্কুলের পাজি ছেলেগুলো ক্রিকেট খেলতে চাইলে ব্যাট হাতে তেড়ে মারতে আসে। বাবলু তাই পালিয়ে যাবে। এজন্যে ওর একশ টাকা প্রয়োজন। একশ টাকা দিয়ে ট্রেনে চড়া যায়। একশ টাকা দিয়ে অনেকগুলো কুলফি খাওয়া যায়। একশ টাকা দিয়ে দুইশটা ঘুড়ি কেনা যায়। বাবলুর একশটা টাকা খুব প্রয়োজন।
বাবা ওকে টিফিনের জন্য চার আনা দেন। চার আনায় দুইটা ঝাল লজেন্স পাওয়া যায়। ঝাল লজেন্স খেলে বাবলুর আর খিদে পায়না। গত দুমাস বাবলু ঝাল লজেন্স খায়নি। টিফিন ছুটিতে ওর তাই খুব খিদা পায়। তখন সে চুপিচুপি স্কুল মাঠের কোণে চলে যায়। সেখানে একটা আমড়া গাছ আছে। খিদে পেলে বাবলু আমড়া পাতা খায়।
খাওয়ার পর তার পেটে মোচড় দেয়। স্কুলের নলকূপ থেকে আঁজলা ভরে পানি খেতে হয় তখন।
প্রতিদিন সকাল ৬ টায় বাবা মানুষটা বাবলুকে ঘুম থেকে ডেকে তুলে দাঁত ব্রাশ করায়।
সকালবেলা দাঁত ব্রাশ করেই ওকে এক গ্লাস ইষবগুলের ভুষি খেতে হয়। খেতে গিয়ে বাবলুর প্রতিবার বমি আসে। মারের ভয়ে সে চুকচুক করে ইসবগুল খেতে থাকে আর বাবা তখন চিড়া আর কলা মেখে খায়। বাবলুর জন্য চিড়ে কলা ঢেকে রেখে বাবা মানুষটা অফিসে যায়।
ইসবগুল খেয়ে বাবলু আর কিছু খেতে পারেনা। বারান্দায় রোজ সকাল সাতটায় একটা মা বিড়াল আর একটা বাচ্চা বিড়াল আসে। বাবলু বিড়াল দুটোকে চিড়ে কলা খেতে দেয়।
সাড়ে সাতটা বাজলে পুরনো রং উঠা শার্ট-প্যান্ট আর ছেঁড়া মোজা জুতো পরে বাবলু স্কুলে যায়।
বাবলুর একটা পলিথিন ব্যাগ আছে। বাবলু তো গরীব। গরীব দেরকে পলিথিন ব্যাগ নিয়ে স্কুলে যেতে হয়।
বাবলুর মনে এই এত্ত এত্ত কষ্ট। দুহাত প্রসারিত করলে যতটুকু হয় ঠিক ততটুকু কষ্ট।
স্কুলের মাঠে সে আকাশ ঝরা রোদের সাথে কথা বলে , গাছের ঝরা পাতার সাথে কথা বলে, সবুজ ঘাসে পিঁপড়ার সারি তাদেরকে বাবলু চিনি খেতে দেয় রোজ।
প্রজাপতির পাখার ছটফটানি শুনতে বাবলু ভীষন ভালোবাসে। রঙবেরঙের ফড়িং এর সাথে তার কত জন্মের বন্ধুত্ব !
বাবলু বৃষ্টি ভালোবাসেনা।
বৃষ্টি এলে ফড়িংপাখিরা লুকিয়ে যায়। আকাশে মেঘ জমলে বাবলুর তাই ভীষণ মন খারাপ হয়। সেই সময় সে তাদের শ্রেণীকক্ষের জানালা দিয়ে বৃষ্টি দেখে, বৃষ্টি শোনে।
বাবলুদের বিজ্ঞান বইয়ে আছে বৃষ্টির পানিতে পানিচক্র হয়। সেই পানি আবার একদিন আকাশে মেঘ হয়ে জমে। আকাশের তাই ওরস্যালাইনের দরকার হয়না। আচ্ছা কান্নার কেনো পানিচক্র হয়না? বাবলুকে তাহলে আর রোজ রোজ ওরস্যালাইন খেতে হতনা!
জুম্মার নামায শেষে বাবার একটা আঙ্গুল ধরে বাসায় ফিরে বাবলু। বাবা স্টোভের চুলা ধরায়। বাবা ডাল আর চাল একসাথে রাঁধে। ডাল-চাল একসাথে রাঁধলে তাকে খিঁচুড়ি বলে।
খিঁচুড়ি রাধার পর বাবা ডিম ভাজবে।
রোজ রোজ খিঁচুড়ি খেতে বাবলুর ভালো লাগেনা।
বাবলুর কোনো আম্মু নেই।
আম্মুরা অনেক কিছু রাঁধতে পারে। মুরগি, নুডলস, পিঠা, সেমাই, বিস্কুট, অনেক কিছু।
ওদের শ্রেণীতে সবসময় প্রথম হওয়া শোভনের আম্মু চকলেট ও রাঁধতে পারে।
বাবা মানুষটা খিঁচুড়ি, ভাত-ভর্তা, আলু ভর্তা, ডাল ছাড়া কিছু রাঁধতে পারেনা।
বাবা মাঝে মাঝে হোটেলে খেতে নিয়ে যায় বাবলুকে। হোটেলে খেতে বাবলুর খুব ভালো লাগে। বাবলু মাছ বেছে খেতে পারেনা। বাবা মাছ বেছে দিলে বাবলুর মাছ খাওয়া হয়!
মুরগীর হাড় চুষে খেতে বাবলুর ভীষন ভালো লাগে।
সন্ধ্যায় বাবা রং চা খায়। বাবলু দুধ খায়। বাবলুর রং চা খেতে ইচ্ছে করে। একশ টাকাটা জমুক সেদিন বাবলু অনেকগুলো রং চা খাবে।
শফি সিগারেট ধরায়।
সিগারেট ভেজা ছিল। ভেজা সিগারেটের ধোঁয়ায় অদ্ভুত একটা মাদকতা। চাকরিটা বড় অসময়ে গেলো। শফি একটা সিগারেট কোম্পানিতে চাকরি করে। বলা যায় করত। গতকাল থেকে তার চাকরি নেই। একটা চাকরি জোগাড় করতে হবে। চাকরির জোগাড় না হলে ছেলেসহ রাস্তায় রাস্তায় ঘুরতে হবে। খেয়ে না খেয়ে থাকতে হবে। না খাওয়ার কষ্টের সাথে শফির অনেক ঘনিষ্ঠ পরিচয় আছে।
আচ্ছা চাকরি না পেলে কি করবে ও? একটা কাজ করা যেতে পারে বাবলুকে সহ ভিক্ষায় নামতে পারে। খুকখুক করে হেসে ফেলল শফি । পরিকল্পনাটা সুন্দর! বাবলুর চেহারায় অনেক মায়া। ভালো ভিখারি হতে পারবে। শফি অন্ধ সেজে করুন মুখ করে ছেলের হাত ধরে হাঁটবে। আর বাবলু করুন সুরে গান গেয়ে ভিক্ষা চাইবে পথচারীদের কাছে। স্টেশনে স্টেশনে, রাস্তায় রাস্তায়, শহরের অলিতে গলিতে ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হবে বাবলুর কন্ঠ।
“এই অন্ধ মানুষটাকে কিছু দেন, বাবারা। আল্লাহ আপনার ভালো করবে।”
একটা পিন ফোটা বেদনায় শফির ভেতরটা টনটন করে ওঠে।
বাবলু পাশেই ঘুমাচ্ছে। ঘরের ষাট পাওয়ারের বাল্বের আলোয় তার গালে পাঁচ আঙ্গুলের ছাপ স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে।
শফি তাকিয়ে থাকে। তাকিয়েই থাকে। তাকিয়েই থাকে। তার চোখে কি একটু যন্ত্রণা হলো?
বিকেলে বারান্দায় বসে চুপিচুপি সিগারেটের প্যাকেট নিয়ে কি যেনো করছিলো বাবলু। শফি তখন বাথরুমে ছিলো। বের হয়ে বাবলুকে ঘরে না পেয়ে বারান্দায় যায় ও। দুপুরে বেশ বৃষ্টি হয়েছিল। বারান্দার মেঝেটা তাই ভেজা ভেজা। বারান্দায় ঢুকেই শফি দেখতে পায় ফ্লোরে একগাদা সিগারেট পড়ে আছে।
ভিজে ত্যানা ত্যানা।
বারান্দার চিপায় বসে বাবলু পিছন ফিরে আছে আর হাতপাখাটা দিয়ে বাতাস করছে। বোধহয় বাতাস করে করে সিগারেট শুকাচ্ছিল।
এই একটা গোল্ডলিফের প্যাকেটই অবশিষ্ট ছিলো শফির। রাত জাগার খোরাক!
ছেলের কাঁধে একটা হাত রাখে শফি। চমকে উঠে পিছন ফিরে বাবলু আর ওকে দেখেই আতঙ্কে জমে নীল হয়ে যায়!
তত্ক্ষনাত রাগে দিশাহারা হয়ে ছেলের গালে কষে থাপ্পড়টা বসিয়ে দেয় শফি !
কি করছিলি! সিগারেট ধরেছিস কেনো হ্যা? বল কেনো ধরেছিস! রাখ আজ তোর হাতই কেটে ফেলব!
বাবলু কাঁদো কাঁদো হয়ে অনুনয় করতে থাকে, ও বাবা হাত কেটে দিওনা। ফ্লোর ভেজা দেখিনি। ও বাবা আর করবনা। আমি প্যাকেট থেকে টিপ আর ঝিলমিল কাগজটা নিতে চেয়েছিলাম। ও বাবা আমি আর সিগারেট ধরবোনা।
শফির মাথা ঠান্ডা হয়না তাতে। চাকরি চলে যাওয়ার ক্ষোভটা ঝাড়ার সুযোগ পেয়ে হাত ছাড়া করেলনা ও। আরো কয়েকটা থাপ্পড় দিয়ে গাল টকটকে লাল করে দেয় বাবলুর। তারপর এক হাত এক পা ধরে চ্যাংদোলা করে রুমে নিয়ে আসে ।
বাবলু ভয়ে আতংকে দিশাহারার মত হাত পা ছুড়ছিল।
বাবলুকে বিছানায় ফেলে দিয়ে রাগে গজগজ করতে করতে বারান্দা থেকে ভেজা সিগারেট গুলো সাবধানে কুড়িয়ে নিয়ে আসে শফি।
একটা হাবলা ছেলেকে জন্ম দিয়ে গেছে নার্গিস। এত মারধর করে তবু একটা না একটা উল্টাপাল্টা কাজ করবেই। হাবলার হাবলা একটা।
সামনের দিনগুলো বেশ ঝাপসা হয়ে চোখের সামনে ভাসে। রুমে শফির মন টেকেনা। ফ্যান নষ্ট দেড় মাস ধরে। বারান্দায় গিয়ে ভেজা ফ্লোরটাতে আবার শুয়ে পড়ে ও। আধপোড়া সিগারেট টা ফেলে দিয়ে অবশেষে হু হু করে কেঁদে ফেলে ও। নিজের কাছে প্রতিজ্ঞা ছিলো ওর যত কষ্টই পাক আর কখনো একটা ফোঁটাও কাঁদবেনা ও। নার্গিস যেদিন মারা গেল ঠিক সেই মুহুর্তপর আর কখনো চোখ থেকে এক ফোঁটা নোনা পানিও গড়িয়ে পড়তে দেয়নি সে।
বারান্দা থেকে আকাশ দেখা যায়। একটুকরো কালো আকাশের দিকে বুভুক্ষের মত তাকিয়ে থাকে শফি। যে আকাশে কোনো নক্ষত্র ফোঁটেনা তাকে রিক্ত আকাশ বলে । শফির ভেতরের আকাশটাও আজ রিক্ত।
বাবলু ভয়ে ভয়ে বারান্দায় গিয়েছিলো। পুরনো দেয়ালঘড়িতে দশটা বাজে। বাবা তখনো উঠেনি। বাবলুর গালের চামড়া উঠে গেছে বাবা মানুষটার থাপ্পড় খেয়ে।
ঘুম থেকে দেরিতে ওঠায় ভয়ে ভয়ে ছিল ও। ব্রাশ করতে গিয়ে দেখে ব্রাশে তেলাপোকা বসে আছে। বাবলু তেলাপোকা ভয় পায়।
তেলাপোকা দেখে ভয় পেয়ে সে আর ব্রাশ করেনি। বাথরুমে ময়লা পানি জমে আছে বাবলু নাক চেপে ধরে বের হয়ে এলো।
রুমে বাবা নেই। তাই বারান্দায় খুঁজতে গিয়েছিল ও। গিয়ে দেখে বাবা ফ্লোরে ঘুমাচ্ছে ।
“বাবা “..
বাবলু ভয়ে ভয়ে ডাকে ।
বাবা সাড়া দেয়না ।
বাবলু আবার ডাকে, আবার ডাকে ।
সাড়া না পেয়ে বাবলুর বুকের ভেতরটা ধক করে ওঠে। বাবা মানুষটা মরে যায়নিতো।
স্কুলে নাতাশার বাবা মারা গিয়েছিলো। নাতাশা সবাইকে কেঁদে কেঁদে বলেছিল মারা গেলে কেউ আর সাড়া দেয়না!
বাবলু ভয়ে ভয়ে বাবার মাথার কাছে এসে বসে। বাবা মরে গিয়ে থাকলে ও কি করবে?
বাবার উদোম গা। লুঙ্গি পরে ঘুমিয়েছিল রাতে। বাবার বুকে ছোট্ট দু হাত রেখে চমকে উঠে সরিয়ে নেয়। বাবলুর হাত পুড়ে গেছে ।
এত গরম কেনো?
“বাবা ও বাবা । বাবলুর কান্না পায় হঠাত্।
বাবা কি মারা যাচ্ছে? বাবা মরে গেলে ওর তো আর কখনো মাছ খাওয়া হবেনা !”
কে ওকে দুয়ের নামতা শেখাবে? কে ওকে চার আনা দেবে?
শফি আবছা আবছা চোখ মেলে।
ঠান্ডায় গা শিরশির করে কাঁপছে ওর। আহা মাথার কাছে কে কাঁদে। সারা শরীর প্রচন্ড ব্যথা করছে ওর। পেটে ছুঁচ ফোটানো যন্ত্রণা হচ্ছে। আলসারের ব্যথাটাই নাকি!
একটা কচি হাতের স্পর্শ পেলো শফি। বুকের উপর। ঘোরের ভেতর চোখ মেলে ও।
আবছা রোদ উঠেছিল একটু আগে বাইরের আকাশটায়। এখন আবার নিভে গেছে। মেঘ জমছে ধীরে অতি ধীরে। একটা ভেজা ভেজা গন্ধ।
শফি একবার তাকিয়ে চোখ বন্ধ করে ফেলে। ছেলেটা কে! দেবদূতের মতো গায়ের রঙ! পরক্ষনেই মনে পড়লো আহা এ তো তারই ছেলে।
জ্বরের ঘোরে বাবলুকে ডাকে ও
“খোকা ও খোকা।”
বাবলু ঝাপসা চোখে অবাক হয়ে থাকায়। এ সুর সে চিনেনা!
এ আদরের ডাকের সাথে সে পরিচিত নয়।
বাবলু বাবার মুখের উপর ঝুকে পড়ে
“বাবা ,ও বাবা!”
শফি চোখ মেলে।
অনেকক্ষন ছেলের মুখে তাকিয়ে থাকে।
পেটের ব্যথাটা তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। একটা যন্ত্রণার অভিব্যক্তি ছড়িয়ে পড়ে ওর মুখে।
এরই মাঝে সে কাঁপা কাঁপা দুহাতে ছেলের মুখটা তুলে ধরে। কি ভয়ানক শীতল স্পর্শ! শফি তপ্ত ঠোঁটে ছেলের গালে চুমো খায়।
কাউকে ভালোবাসতে শফির বড়ো ভয় হয়। এ জীবনে যাকেই সে ভালোবেসে আঁকড়ে ধরতে চেয়েছে তারা সবাই ফুরিয়ে গেছে, দিন শেষ হওয়ার আগেই সিগারেটের ছাইয়ের মত ঝরে গেছে। এ ছেলেটাকে তাই সে ভালোবাসেনা। দুচক্ষে দেখতে পারেনা। ছেলের জন্য তার কোনো মমতা নেই , কোনো মমতা নেই।
বাবলু কাঁদতে কাঁদতে বাথরুমে যায়। কাঁদলে ওরস্যালাইন খেতে হয়। এখন তার পানি দরকার। এক বালতি পানি। ওরস্যালাইনের জন্য নয়। বাবা মানুষটার মাথায় পানি ঢালবে।
বাবার জ্বর এসেছে। গা গরম হলে তাকে জ্বর বলে। জ্বর এলে মাথায় পানি ঢালতে হয়।
বাবলুর ও একদিন জ্বর এসেছিল।
বাবা মানুষটা সেদিন সারারাত তার মাথায় পানি ঢেলেছে।
শফি আধখোলা ঘোর ঘোর চোখে দেখতে পায় বাবলু প্রাণপনে ছোট্ট দুহাতে তার চেয়ে কয়েকগুন বড় বালতিটা টেনে টেনে আনছে। আলগানোর ব্যর্থ চেষ্টা করছে কাঁদতে কাঁদতে ।
শফি বিড়বিড় করে ,”আহারে খোকা, লক্ষী মানিক আমার, ফড়িং আমার, কাছে আয়। তোকে একটু আদর করে দিই।”
বাবলু কান্না চাপতে চাপতে ব্যাংক টা খুঁজে বের করে। ব্যাংকে পঁচাত্তরটা চার আনা আছে। ব্যাংকটা ভাঙ্গতে হবে। পঁচাত্তরকে চার দিয়ে ভাগ করলে সাইত্রিশ দশমিক পাঁচ হয়। বাবলু খুব ভালো ভাগ পারে। ব্যাংকে সাঁইত্রিশ দশমিক পাঁচ টাকা আছে। বাবার পেটে ব্যথা।
প্যারাসিটামল খেলে ব্যথা সেরে যায় বাবলু সেটা জানে। সাইঁত্রিষ টাকায় অনেক গুলো প্যারাসিটামল হয়।
বাবলু মাটির ব্যাংকটা হাতে তাদের বাসার সরু কাঁদামাখা রাস্তাটা ধরে ছুটে যায়। সেই সংকীর্ণ রাস্তা ধরে ছুটতে ছুটতে বাবলুর মনে হতে থাকে পৃথিবীটা অনেক বিশাল, অনেক অনেক বিশাল।