গোমড়ামুখে বসে ছিলাম। এইমুহুর্তে ওটি ড্রেস পরে দৌড়াচ্ছি। আজকে আমাদের এনিভার্সারি। মানুষটা ভুলে গেছে। মনে করিয়ে দেয়ার ঠেকা কার পড়েছে? পকেটে মুঠোফোন, বন্ধ করে রেখেছি। শাস্তি।
বছর পঁচিসের মেয়েটা যন্ত্রণায় কাতরাচছে
। তা প্রায় ঘন্টাখানেক হবে। সাদা চাদরটা য় লাল রঙের নকশা ফুটে উঠেছে। প্রচুর ব্লিডিং হচ্ছে। এনেসথেশিয়া দেয়া হয়েছে। সিজার হবে। রাশেদা ম্যাম গম্ভীর মুখে ওটি টেবিলের পাশে দাড়িয়ে আছে। হন্তদন্ত হয়ে ঢুকতেই ঝাড়ি দিলেন,এত লেইট কেন আপনার?
সিনিয়র মানুষ। ঝাড়িটা হজম করতে হলো। পাঁচ মিনিট দেরি হয়েছে।
আমি চশমাটা চোখে পরতে পরতে মৃদু কন্ঠে বললাম,সরি ম্যাম।
রাশেদা ম্যাম তৈরি ছিলেন। ট্রে থেকে অন্যমনস্ক হয়ে ফরসেপস হাতে তুলে নিলাম। এন্টিসেপটিক ওয়াশ দিতে হবে। ফার্স্ট বেবি। অবস্ট্রাক্টেড লেবার।
বাড়িতে নরমাল ডেলিভারি করানর ট্রাই করা হয়েছিল। বাচ্চা আর মা দুজনের অবস্থাই খারাপ করে নিয়ে এসেছে।
আধা ঘন্টা পর ওটি রুম থেকে বের হলাম। ঘামে পিঠ ভিজে গেছে।
ফোন চালু করলাম। চালু করতেই হোয়াটস এপের মেসেজ টোন।
-সুন্দরী, হু হা হা হা! ভাবসো আমি ভুলে গেছি! জীবনের সবচেয়ে প্যাথেটিক দূর্ঘটনাটা ভুলে যাই কী করে? হ্যাপি এনিভার্সারি 😑
হেসে ফেললাম।
-কপালে দুঃখ আছে ডাক্তার সাহেব। এক বালতি কাপড় ভিজিয়ে রাখসি। বুয়া আজকে আসেনাই। এতদিন তো প্যাথেটিক ছিল না আজ থেকে হাড়ে হাড়ে প্যাথেটিক করে দিব।
-আমি আজকে বাসায় আসবোনা। টাটা। 😕
-তুমি আসবানা তোমার চৌদ্দগুষ্ঠি আসবে।
– ওকে ফোন করে চৌদ্দগুষ্ঠিকে জানিয়ে দেয়া হবে 😘
– আমি আসতেছি। ওয়েট!
-দারোগা বউ!
– গরররর
-হ্যান্ডস আপ আইন নিজের হাতে তুলে নিবেন না!
– আসি আগে!
– চেম্বারে কোয়ি নেহি হ্যায়!
– মানে?
– মানে আমি ডেটিংয়ে আসছি!
-শালা, শয়তান! ঘরে বউ রেখে 😣
বুঝছিতো এজন্যই দুপুরবেলা নাম্বার বিজি ছিল!
– 😘 নিচে রিসেপশনের সামনে আছি। এসে উদ্ধার করো লাইলী বেগম!
রিপ্লাই লিখতে লিখতে ঠোঁটের কোনে নিজের অজান্তেই হাসি এসে পড়েছে। লিফট ম্যান অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। আমি বিব্রত হলাম।
# # #
রিকশায় বসতে না বসতেই এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেল।
শুভ আমার হাত দুটো শক্ত করে ধরে রেখেছে। হুড তুলে দিয়েছে যেন ভিজে টিজে না যাই।
– জানো আজ টুইন বেবির ডেলিভারি করেছি।
আমার কন্ঠ শিরশিরে বিষন্নতায় ঢেকে গেল।
-ওটি থেকে বের হয়ে ওদের বাবার হাতে দুমিনিটের জন্য তুলে দিতেই ওয়া ওয়া করে কেঁদে ফেলল। বাবাটা কী সুন্দর আজান দিলো। তারপর নিওন্যাটে পাঠিয়ে দিলাম।
গলা ভার হয়ে আসছে। প্রতিদিন ক্লিনিকে ডেলিভারি করিয়ে এসে পাশে বসে থাকা শান্তশিষ্ট ছেলেটার বুকে আমি মুখ লুকিয়ে কাঁদি।
টের পেলাম আমার কাঁধে শক্ত একটা হাত। আজও আমি বোকা মেয়ের মত ফুঁপিয়ে উঠলাম।
ভেতরটা প্রতিনিয়ত থৈ থৈ করছে। কেউ টের পায়না। একটা মানুষ ছাড়া।
সবাই জানে সমস্যাটা শুভর। অথচ আমরা দুজনেই জানি সমস্যাটা কার।
এই জানাটুকুই সব নয়। তার বাইরেও ভালবাসা থাকে, শান্ত নদীর মত বয়ে চলে। কোথাও থামেনা।
– আসো ভিজি।
– ঠান্ডা লাগবেতো!
– লাগুক। ডাক্তারের সাথে ভিজলে ঠান্ডা লাগেনা…
শুভ গম্ভীর।
আমি ওর গাম্ভীর্য দেখে হেসে ফেলি।
– এভাবে হাসবানা! এতবার প্রেমে পড়লেতো সমস্যা!
হুডটা ফেলতে ফেলতে শুভ বিড়বিড় করল।
চোখে জল আসি আসি করছে আবার!
আমার হাসি আহামরি কিছু নয়। দাঁত বত্রিশটা মাড়িসহ বেরিয়ে যায়!
ভেজা চোখ নিয়ে আমি তবু হাসতে থাকি।
মানুষটা প্রেমে পড়ুক। বারবার… বারবার…
