“ভাইয়া, ইমার্জেন্সি থেকে মাত্র এলো যে পেশেন্টটার,ওঁর বিপি পাচ্ছিনা, পালস ফিবল, নাই বললেই চলে।”
সময় দুপুর দেড়টা। হাঁপাতে হাঁপাতে হন্তদন্ত হয়ে ডক্টরস রুমে ঢুকল ইন্টার্ন ডাক্তার মিলি।
মাথার চুল উশকু খুশকি। এপ্রনের কলার উল্টে আছে। চোখ লাল। গতকাল নাইট ডিউটি ছিল। ডিউটি আওয়ার চৌদ্দ ঘন্টা অতিক্রম হয়ে গেছে এরইমাঝে। হঠাৎ ওর উপর চোখ পড়লে সাদা কাপড়ে জড়োসড়ো, কোন এক উদ্বাস্তু শিবিরে বসবাসরত দুঃখী শরণার্থী বলে ভ্রম হয়।
রাাউন্ড ক্লাস শেষে মিড লেভেলের ওরা কয়েকজন তখন বই খুলে জটিল একটা ইসিজি বোঝার চেষ্টা করছে মাত্র।
“কোন রোগী?”
“বেড নং থার্টি থ্রি। এই যে ফাইল। একটু আগের ইসিজি।
ফাইল দেখতে দেখতে ডা.শফিক দাঁড়িতে হাত বুলাল।”
“জাহেদ যাতো। দেখে আয়। পেশেন্টের হাইপারথাইরয়েডিজম আছে। এট্রিয়াল ফিব্রিলেশনের জন্য ওয়ারফেরিন ট্রিটমেন্ট পাচ্ছিল। এক বছর আগে ইশকেমিক স্ট্রোক করেছে। এই ইসিজিতে দেখি এম আই এসেছে। কার্ডিয়াক এরেস্ট হতে যাচ্ছে খুব সম্ভব।”
সহযোদ্ধার কাছ থেকে ফাইলটা নিয়ে চশমা ঠিক করে চোখ বুলাল কয়েক সেকেন্ড,তারপর স্টেথোস্কোপটা কাঁধে ফেলে ওয়ার্ডের দিকে ত্বরিতগতিতে অগ্রসর হলো ডা.জাহেদ। নতুন রেসিডেন্ট,কার্ডিওলজি।
ভারী পদক্ষেপে দ্রুত তালে হাঁটতে হাঁটতে পিছনে মৃদু পায়ে ছুটতে থাকা অথচ তাল মেলাতে না পারা ইন্টার্নকে উদ্দেশ্য করে একটু ভাব দেখিয়ে বলল,
“এট্রিয়াল ফিব্রিলেশনের একটা কমপ্লিকেশন বলো?”
“জানিনা ভাইয়া।”
“একটা কজ?”
“জানিনা ভাইয়া। সার্জারি সাপ্লি ছিল। মেডিসিন ছয় মাসে সব ভুলে গেছি।”
“গুড! পড়াশোনা করবা বুঝলা!”
কন্ঠস্বরে অবজ্ঞা প্রকাশ পেল নাকি! মিলি বুঝে উঠতে পারল না।
“নলেজ ইজ পাওয়ার। এখন জলদি এক এম্পুল এট্রোপিন,এক এম্পুল স্টেরয়েড নিয়ে আসো সিস্টারস রুম থেকে।
কুইক মার্চ!”
মিলি মনে মনে রেগে গেল,নাইট ডিউটি ভাল যায়নি। সকালে আধ ঘন্টার ছুটি চেয়েছিল। সিএ ছুটি দেয়নি। আর এই লোকটা;কাঠখোট্টা, চামার কাহাকা, ওর অধীনে থাকা চারটা বেডের কেস হিস্ট্রি লিখিয়েছে। ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে এক বেড এর হিস্ট্রি আরেক বেডের ফাইলে লিখে ফেলছিল মিলি। হাইপারক্যালেমিয়ার পেশেন্টের ফাইলে ডিগক্সিন দেখে কনসালটেন্ট স্যার ফাইলটা রেগেমেগে জাহেদের মাথা সই করে ছুড়ে মেরেছিলেন। একটুর জন্য লক্ষভ্রষ্ট হতে যেয়েও হয়নি। আনন্দে দু রাকাত নফল নামাজ পাঠের নিয়ত করেছে মিলি। মহাকেলেংকারী বাধিয়ে দিয়েছিল সে আজকে যদিও! যাহোক,সে তো এই লোকটার জন্যই ! একটু ভাব নেওয়ার সুযোগ পেলে লোকটা নিজেকে যে কী মনে করে! বেটা ওয়ার্ডে জয়েন করেছে তিন দিন হলো। আসার পর থেকেই দেখছে হামবড়া ভাব! আর বকা ঝকাতো আছেই! সারাদিন শুধু নিজেকে জাহির করার তালেই থাকে। আর পড়াশোনা। আরে বাবা,সারাদিন এত পড়া পড়া করিস কেন? হ্যারিসনের বিশাল ভলিউমটা দিয়ে এই লোকের মাথায় একটা বারি মারলে পারলে শান্তি পেত মিলি।
জাহিদ প্রায় উড়ে চলল তেত্রিশ নম্বর বিছানার দিকে। তেত্রিশ শব্দটা দিয়ে একটা বিখ্যাত কবিতা আছে। জাহেদ মনে করার চেষ্টা করছে। কিন্তু পারছেনা। ডক্টরস নাইট ফাংশনে কেউ একজন আবৃত্তি করেছিল। কী অদ্ভুত! রোগীর জীবন আর মৃত্যুর মাঝে এক মিনিটের ব্যবধান। আর তার মাথায় এখন কবিতার চিন্তা আসতে হলো! এমন না সে খুব কবিতা পছন্দ করে। সত্যি বলতে কেউ যদি তাকে প্রশ্ন করে,আপনার প্রিয় কবিতা কোনটি? সে মুখ গম্ভীর করে জবাব দিত,আই হেইট পয়েমস!
ডক্টরস রুম হতে রোগীর বিছানা সামান্য কয়েক সেকেন্ডের পথটুকু মনে হলো কয়েকহাজার আলোকবর্ষ দূরত্ব রচনা করে রেখেছে।
রোগীকে ঘিরে আছে গোটা পনেরজন মানুষ। আহাজারি করছে সবাই। কার্ডিওলজি ওয়ার্ডে ভিজিটিং আওয়ারে খুব অল্প সংখ্যক মানুষকে ঢুকতে দেওয়া হয়। এরা কীভাবে যেন ঢুকে পড়েছে।
বিশাল বপু একজনকে উদ্দেশ্য করে জাহিদ রাগান্বিত স্বরে বলল, “প্লিজ এক্সকিউজ আস। উই হ্যাভ টু এটেন্ড দা পেশেন্ট। সাইড প্লিজ। কান্ট ইউ সি দিজ পেশেন্ট ইজ ইন ক্রিটিকাল সিচুয়েশন?”
ক্লাস এইট পর্যন্ত ইংলিশ মিডিয়ামে পড়ে ওর এই হয়েছে এক বিপদ। রেগে গেলে ইংরেজী চলে আসে। একদিকে মনে হয় লাভ হলো। চ্যাটাং চ্যাটাং ইংরেজী শুনে মানুষগুলো একটু হতভম্বের মত চোখ পিটপিট করল, আহাজারি থামিয়ে কিঞ্চিত জায়গা করে দিল দয়া করে।
ষাটোর্ধ রোগী। চোখ বন্ধ,মুখটা নীল হয়ে আছে। যদিও অক্সিজেন চলছে। ক্ষীন প্রায় নিঃশ্বাস। পালস অনুভব করা গেল না।
রোগীর গলায় বিশাল একটা মাংসপিন্ড ঝুলছে, মহাবিপ্লবী থাইরয়েড গ্ল্যান্ড। রোগীর পাশে দাঁড়ানো ফেরেশতা আজরাইলকে দেখতে পেল যেন জাহিদ,যার সাথে নিত্য তাদের মধ্যস্থতা করতে হয়।
“মাই ডিয়ার এনজেল এনাকে কী আর দুইটা দিন গিফট দেওয়া যায়না ?”
বিড়বিড় করতে করতে আম্বু ব্যাগ টা রোগীর মুখে লাগিয়ে সিপিআর শুরু করল জাহিদ। প্রচন্ড পরিশ্রমের একটা কাজ।
আশেপাশে মৃদু গুঞ্জন,”রোগীটাকে এত চিপতেসে কেন? বুক ভাঙি যাবে তো!”
লোকাল ভাষায় একজন বাঁজখাই গলায় বলল, “এইল্লে চিবর ক্যা!”
ডিফিব্রিলেটর মেশিন শক দেওয়ার জন্য রেডি। একটা এট্রপিনের এম্পুল নিয়ে ছুটে এসেছে মিলি। কাঁপা হাতে এট্রপিনের এম্পুল ভাঙতে গেল। এম্পুল ভাঙার বিশেষ নিয়ম আছে। নার্সরা রোজ তিনবেলা এম্পুল ভায়াল এসব ভাঙতে ভাঙতে একেকজন ওয়ার্ডসেরা ভাঙনবিদ হয়ে উঠে। মিলির হাত কাঁপছে। এম্পুলটা এত শক্ত মনে হচ্ছে কেন! বুড়ো আঙুলে প্রেশারটা বাড়াল। হচ্ছেনা। আরেকটু জোরে। হয়না কেন! ভাঙে না! আরেকটু জোর! আরেকটু… হতেই হবে! ভাঙতেই হবে,রোগী মারা যাচ্ছে! টকটকে লাল মুখে এম্পুল ভাঙার ট্রাই করছে মিলি,মুহূর্ত কি থমকে গেছে?
“ম্যাডাম, আমাকে দেন!”
সিনিয়র একজন নার্স বললেন। তিনি ছুটে এসেছেন কে যেন তাঁকে জানিয়েেছে এই রোগীকে দেখতে গতকাল মন্ত্রী সাহেবেরর শালা এসেছিলেন।
“হয়ে গেছেত…”
মরিয়া হয়ে সর্বশক্তি দিয়ে এম্পুলের মাথাটা কাঁত করে ভাঙার শেষ চেষ্টা করল মিলি। সবার সামনে নিজেকে অযোগ্য দেখাতে চায়না।
তৎক্ষনাৎ গ্যাট করে একটা শব্দ হলো। এইতো ভেঙে গেছে। কিন্তু হাতে হালকা একটা ব্যথা অনুভূত হলো ওর। পাশে দাড়ানো রোগীর একজন আত্মীয় চেঁচিয়ে উঠল,”ওবাজি আঁতহাডি ফেইল্লে!”
শুদ্ধ ভাষায় অনুবাদ করলে, ওরে বাবা হাত কেঁটে ফেলেছে!
জাহিদের মাথায় কে যেন বাক্যটা আক্ষরিক ইংরেজীতে অনুবাদ করে দিলে,”ও মাই ফাদার! হ্যান্ড হ্যাজ বিন কাট! ধুর!!!! কীসব!”
কার হাত কীসের হাত দেখার সময় নাই ওর।
এক দুই তিন চার… রোগীর বুকে পাগলের মত চাপ দিয়ে যাচ্ছে সে।
সম্বিত ফিরল যেন মিলির।
চুইয়ে রক্ত ঝরছে ওর হাত হতে,সরু ধারাটা কনুই পর্যন্ত নেমে এসে ওর এপ্রনটাকে রক্তাক্ত করে দিলো, হাঁত কেপে উঠল ওর। এত রক্ত! পেটের ভেতর কেমন যেন করে উঠল। অন্ধকার একটা ছায়া পর্দা ফেলল চোখের সামনে, রোগীর বেডের একটা পাশ খামচে ধরে ফ্যাকাশে মুখে পা দুটো ফ্লোরের উপর চেপে শক্ত করে দাঁড়িয়ে রইল মিলি।
ভাঙা এম্পুলটা হাত হতে যেন স্লো মোশনে ফ্লোরে আছড়ে পড়ল। মিলির মনে হলো ফ্লোরে না ওর হৃদপিন্ডের বাম নিলয়ের উপর পড়ল এম্পুলটা!
“হোয়াট দা হেল! একটা কাজ ও ঠিকমত করতে পারোনা। কাউন্সেল দেম। পেশেন্টের কন্ডিশন জানাও। এট্রপিন কই?”
গজগজ করতে করতে মুখ না ফিরিয়েই কড়া স্বরে বলল জাহিদ।
পাশে দাঁড়ানো সিনিয়র নার্স মিসেস মীরা নার্স রুমের দিকে ছুটলেন ফের।
রক্তাক্ত শিক্ষানবীশ ডাক্তারকে খেয়াল করেনি আসলে জাহিদ।
আর মিলি থতমত খেয়ে ভাঙা এম্পুল আর নিজের রক্তাক্ত হাতের দিকে তাকিয়ে আছে। ওয়ার্ডে এত হৈ চৈ! মাছের বাজার নাকি!
“আশ্চর্য, এত হৈ চৈয়ে মাথা ঠান্ডা রেখে কাজ করা যায়। “
বিড়বিড় করল জাহিদ।
আশে পাশো বেডে ফ্লোরে সর্বত্র হৃদরোগী। এদেরও তো সমস্যা হবে। মানুষগুলো এত ঝামেলা করছে কেন। এরা একটু বাইরে যায়না কেন!
“দাদু, মানুষ কমান।”
কে শোনে কার কথারে বাবা। পাঁচশ টাকা বাগিয়ে নিয়ে সবাইকে ঢুকতে দিয়েছে, এখন বের করে কীভাবে! একটু গাইগুই করে বকাঝকার ভান করে সরে গেল দারোয়ান সাহেব।
জাহিদ ঘামছে। এই রোগী কি বাঁচবেনা? কার্ডিয়াক মনিটরিংয়ে হালকা উঠনামা চলছে।
“ওয়ান টু থ্রি!”
শক দিতেই কাটা কলাগাছের মত রোগীর শরীরটা থুবড়ে পড়ল বিছানায়।
“আবার,ওয়ান টু থ্রি…”
কানে ঝি ঝিঁ পোকার ডাক শুনতে পাচ্ছে জাহিদ। একটা গন্ধ এগিয়ে আসছে ওর দিকে ধীরে ধীরে। গন্ধটা মৃত্যুর। নাহ.. প্লিজ আরেকটু সময় দাও বিধাতা.. মানুষটা প্রিয়জনদের যেন বিদায় জানাতে পারে..যেন ক্ষমা চেয়ে নিতে পারে.. প্লিজ!
মিলি কাঁপা কাঁপা স্বরে রোগীর আত্মীয়স্বজনদের দিকে তাকাল,আঙুল চেপে ধরে রাখায় রক্তপাত বন্ধ হয়েছে। কিন্তু ক্ষতস্থানটা জ্বলছে ওর।
“আপনারা একটু বাহিরে আসেন আমার সাথে। প্লিজ!”
“আমরা বাইরে যাবনা। রোগী র এই কন্ডিশন! পাঁচশ টাকা দিয়ে ঢুকসি রোগীর পাশে থাকার জন্য।”
“একটু প্লিজ! কারো সাথে কথা বলতে হবে আমার!”
“উনারা হয়ত বুঝবেনা কী ঔষুধ লাগবে আমাকে বলেন।
ষোল সতের বছরের এক তরুন বলো উঠল। “
“একটু আসোতো ভাইয়া। “
কেটে যাওয়া হাতটা চেপে ধরে আছে মিলি। কাঁচের গুড়ো ঢুকেছে কিনা কে জানে। সার্জারি ওয়ার্ডে যাওয়া দরকার। তার এই অবস্থা দেখেও তাকে কাউন্সেলিংয়ের মত জটিল কাজটা করতে বলায় সে মনে মনে একটু আহত হয়েছে , এই মানুষটা আসলেই একটু কেমন যেন। কাঠখোট্টা। চেহারাটাও পাথরের মত। সেন্টমার্টিনে দেখে আসা এবড়ো খেবড়ো প্রবাল পাথর!
এক পাশে নিয়ে এলো ছেলেটাকে
“নাম কী তোমার? কিসে পড়ো?”
“হাসান, এইচএসসি দিলাম।”
“তোমার কে হয়?”
“দাদু। সিস্টার কী অবস্থা উনার আসলে?”
সিস্টার ডাক শুনে একটু মুখ তুলে তাকাল মিলি। কিছু বললনা। ডাক্তার হয়েও সিস্টার ডাকটা শুনতে শুনতে অভ্যস্ত হয়ে গেছে।
“তোমার দাদুর হার্ট এটাক করেছে। আমরা চেষ্টা করছি। ওই যে মেশিনটা দেখছো ওটা সর্বশেষ চেষ্টা। আমাদের হাতে কিছু নাই। আমরা চেষ্টা করতে পারি মাত্র। তাই করছি। সর্বশক্তিমান কে ডাকো। তোমার আত্মীয় স্বজন সবাইকে এটাই করতে বলো। “
হাসান পাংশু মুখে বলল, দাদুর বাঁচার আশা নাই?
“না। আপাতত নাইনটি নাইন পারসেন্ট নাই।”
“আমার কথা কেউ শুনবেনা। দাদু মারা গেলেই চাচারা খেপে যাবে। আমার চাচারা তেমন শিক্ষিত না। বুঝবেনা। সবাই খেপে আছে। সরকারী মেডিকেলে ভর্তি করানয় আব্বার উপর খেপে আছে সবাই। আব্বার কিছু করার ছিলনা। বাসা থেকে কাছে তাই ইমার্জেন্সিতে নিয়ে আসছিল। আব্বা এখন একটু অফিসে গেছে। ছুটি নিতে। আব্বা বুঝতো হয়ত!”
চিন্তিত স্বরে বলল হাসান।
মিলি অসহায়ের মত নিজের রক্তাক্ত এপ্রনটার দিকে তাকাল। অদূরে পেশেন্টকে ডিসি শক দিতে থাকা ডা.জাহিদকে দেখল এক পলক।
মানুষটার জন্য মায়া লাগছে ওর হঠাৎ।
এই রোগী-পাগল, আঁতেল মানুষটা মার টার খাবে নাতো আবার! আচমকা গা ঝাড়া দিল যেন ও!
“উনারা না শুনলেও বিষয়টা জানাব। আসো। আমি সহ বলি।”
তখনো ইসিজিটা সরলরেখায় পরিনত হওয়ার অপেক্ষায়। জাহিদ চেষ্টা বন্ধ রাখেনি। তারপর যখন একসময় ইসিজিতে ফ্লাট লাইন চলে এলো সে ক্ষান্ত হলো।
“আই এম সরি!”
“কীসের সোরি!”
“মানে কী!”
“ওরে আল্লারে!”
সমস্বরে কান্নায় ভেঙে পড়ল যেন পুরো কার্ডিও ওয়ার্ড,
জাহিদ রনাঙ্গনে পরাজিত যোদ্ধার মত মাথা নুয়ে রাখল।
“আগেই বলছিলাম এখানে ভর্তি না করায়ে সিঙ্গাপুর নিতে।”
“এরা কিছু পারে! কী করল এতক্ষন উল্টাপাল্টা! চিপাচিপি করল। কারেন্টোর শক দিই রোগী মারি ফেলল!”
জাহিদ একটু অবাক হলো। কী বলতে চাইছে এরা! এরা কি ডেভিডসন পড়েনি! এরা কি হ্যারিসন সাহেবকে চেনেনা! এরা কি জানেনা কেমন করে এমআই হয়! এরা কি জানেনা কত এমজি এসপিরিনে লোডিং ডোজ হয়! ওহো! এদেরতো ডেভিডসন পড়ার কথা না! কী যে হয় ওর! ডেডবডি সামনে থাকলে মাথা কাজ করেনা। আচমকা ওর এপ্রনের কলারে কার যেন হাত পড়ল।
একইসাথে হতভম্ব এবং অবাক হওয়াকে সম্ভবত হতবাক বলে। জাহেদ এই মুহূর্তেহতবাক।
“এক্সকিউজ মি,ডোন্ট ইউ নো হোয়াট ইজ সাডেন কার্ডিয়াক ডেথ? লেট মি এক্সপ্লেইন প্লিজ!”
“শালা তোর ইংরেজীর মারে …”
জাহিদ কার্ডিয়াক এরেস্ট, স্ট্রোক এমআই ইটিসি বিষয়ে লেকচারটা মনে মনে প্রস্তুত করে রেখেছিল। সেটা স্মার্টলি উগরে দেওয়ার জন্য মুখ খুলতে নিয়েছিল সবেমাত্র,
তার আগেই নাকের উপর প্রথম ঘুষিটা খেল। তারপর আরেকটা। পরপর দুটো। আবার ফের একটা।
ফ্লোরের উপর ডিগবাজি খেল জাহিদ। মাথায় ভয়াবহ আঘাত পেল দেওয়ালের সাথে। এক সেকেন্ড লাগল ধাতস্থ হতে।
ফ্লোরে শুয়ে আবিষ্কার করল চশমাটা নাকের উপর নেই। ঝাপসা চোখে কে মেরেছে দেখার আগেই বুঝতে পারল একটা মানুষ ওকে সামনে থেকে আগলে রেখেছে,চশমা না থাকায় ঠাহর করতে পারলনা,
“যে মোরে দিয়েছে বিষে ভরা বাণ আমি দেই তারে বুক ভরা গান! বুক ভরা গান? আই মিন বম্দুক? হু দা হেল!
এই কবিতা কার লেখা! মাথায় কে তুমি বাবা বসে বসে কবিতা বলছো?”
“ওহ নো! আই হেইট পয়েমস!”
জাহিদ বিড়বিড় করল আবার।
“কী করছেন আপনারা, অমানুষ নাকি! আপনাদের রোগীকে বাঁচানর জন্য হাতটা পর্যন্ত কেটে ফেলছি দেখেন! চোখ নাই আপনাদের!”
মিলি চিৎকার করছে সমানে। রক্তাক্ত হাতটা সবার সামনে নাড়ছে।
মহিলা ডাক্তার দেখে এক মুহূর্তের জন্য থমকে গেল ওরা। মিলির রক্তাক্ত এপ্রনটা, আর চিৎকার ওদেরকে বিভ্রান্ত করে দিয়েছে।
ঝামেলা হচ্ছে বুঝতে পেরে ডক্টরস রুম হতে বাকী রেসিডেন্টরাও বের হয়ে এসেছে। ডা.শফিক ছুটে আসতে আসতে কাকে যেন ফোন দিল, হাসপাতাল টহলে নিয়োজিত কয়েকজন আনসার সদস্য পাঠাতে।
হাসান নামের ছেলেটা ফ্যাকাশে মুখে তার উত্তেজিত কাছের মানুষগুলোকে কিছু একটা বোঝাচ্ছে।
মৃত্যু সহজ, মৃত্যু সুন্দর। তবু সবাই মৃত্যু মেনে নিতে পারেনা। প্রিয়জনের মৃত্যু নিউরোট্রান্সমিটার লেভেল উলটপালট করে দেয়। তবু ওদেরকে আসলে বোঝানো দরকার। রোগীর মৃত্যুটা! হাউ এন্ড হোয়াই ডিড ইট হ্যাপেন!
জাহিদ এসবই ভাবতে ভাবতে উঠে বসেছে। আশে পাশে তাকাচ্ছে ঝাপসা দৃষ্টিতে। চশমা খুঁজছে বুঝতে পেরে মিলি উবু হয়ে বসে ফ্লোর থেকে চশমাটা কুড়িয়ে ওর চোখে পরিয়ে দিল। ভেঙে গেছে চশমাটা। ভাঙা চশমার আড়ালে জাহিদের বিপন্ন মুখ দেখতে দেখতে মিলির মন খারাপ হয়ে গেল, কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল
“শোনেন, আর কয়েকটা কিল ঘুষি খাওয়ার ইচ্ছা না থাকলে অযথা লেকচার দেওয়ার চেষ্টা না করে সরে যাওয়ার চেষ্টা করুন। বেশি ভাল হয় আমার কাঁধে মাথা রেখে অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার অভিনয় করলে।”
এই মেয়ে কী বলছে আসলে? কানে ঝিঁঝিঁ পোকার আওয়াজ ছাড়া কিছুই শুনতে পাচ্ছেনা কেন সে?
ও হ্যা, থার্ড ঘুষিটা কানের উপর খেয়েছে জাহিদ। বিশাল বপু লোকটাই দিয়েছে! ডান ম্যাস্টয়েড প্রসেসটা ভেঙে গেছে মনে হয়!
“হাজার বছর ধরে আমি পথ হাঁটিতেছি… শাট আপ! আই হেইট পয়েমস!”
মাথার ভিতরের মানুষটাকে বকতে বকতে মিলিকে দেখল জাহিদ।
জিভে একটা নোনা স্বাদ। রক্তে ওর মুখ ভেসে যাচ্ছে। ঝাপসা ব্যাকগ্রাউন্ড তার মাঝে মিলির গোলগাল মুখটা দেবী প্রতিমার মত জ্বলছে। আচ্ছা মিলি নামের মেয়েগুলোর মুখ কি গোল হয়?
“টু বি অর নট টু বি দ্যাট ইজ দা কোয়েশ্চেন”,মিলির মুখের দিকে তাকিয়ে আচমকা শেক্সপিয়র মনে পড়ে গেল জাহিদের। কী অর্থহীন আর অদ্ভুত!
“উঠতে পারবেন? উঠতে না পারলে অজ্ঞান হয়ে যান প্লিজ।
এত মায়াবী মুখটা কার? এত মিষ্টি করে অজ্ঞান হয়ে যেতে বলে!”
তেত্রিশ বছর কেটে গেল কেউ কথা রাখেনি! উহু! ইটস টুয়েন্টি নাইন!
জীবনের আনন্দ নিয়ে জীবনানন্দ বলেছিলেন,
‘মরণের পরপারে বড়ো অন্ধকার
এই সব আলো প্রেম ও নির্জনতার মতো।’
হৈ চৈয়ের ভিতর, ঝিঁঝিঁ পোকার শব্দের ভিড়ে মিলির মুখনিঃসৃত বাক্যটা কানে প্রবেশমাত্র জাহিদ সত্যি সত্যিই অজ্ঞান হয়ে গেল।
মিলি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। মানুষটার নিঃশ্বাস এসে পড়ছে তার কোলের উপর। বয়স্ক একটা পেশেন্টের ডেডবডি সামনে রেখে রোমান্টিক কিছু মাথায় আসার কথা না। তবু ওর মনে হচ্ছিল এভাবেই ওর কোলের কাছে পড়ে থাক চেনা অথচ অচেনা মুখটা। ডেভিডসনের বাইরেও যে কান্ডজ্ঞান বলে কিছু শেখার আছে, কিছু মুহূর্তে পালাতে হয় কিছু মুহূর্ত সামলাতে হয় সেটা শেখানর দরকার আছে এই লোকটাকে! বাকী জীবন সেটা শেখানর যদি সুযোগ পাওয়া যেত? চেষ্টা করতে ক্ষতি কী?