ভোকাট্টা

“লিয়াপু, আবীর ভাইয়া তোমাকে এটা দিয়েছে”,
রঙচঙে কাগজটা লিয়াপুর হাতে ধরিয়ে দিয়ে আমি আবীর ভাইয়ার কিনে দেওয়া হাতের আচারটা চাঁটতে চাঁটতে দিলাম ছুট।

কাগজে কী লেখা আছে আমাকে পড়তে নিষেধ করা হয়েছিল। কিন্তু আমি পড়ে ফেলেছি। পড়তে আমার খুব ভাল লাগে। মা বলেছে যেখানে যা লেখা দেখতে পাবি সব লেখা পড়বি।
কাগজে লেখা ছিল
“আমি একটা ভোকাট্টা ঘুড়ি। তুমি আমার চলন্ত আকাশ।”

লিয়াপু একদিন বলেছে , “তোর আবীর ভাইয়া একটা পাগল।
কাগজে করে পড়া লিখে পাঠায় ।
আমাদের কলেজে অনেক পড়া বুঝলি। সব পড়া তোর আবীর ভাইয়া বুঝতে পারেনা। কাগজে লিখে পাঠায়।
আমি লিখে বুঝিয়ে দেই।”

লিয়াপু এত করে পড়া বুঝানর পরেও আবীর ভাইয়া নাকি ইংলিশে ফেল করেছে । বোধহয় লিয়াপুটা ভালমত পড়া বুঝায়নি।

রাস্তায় আমাকে দেখতে পেয়ে ছাদ থেকে মা ডাক ছাড়লেন, শশী তেলের বোতলটা একটু নিয়ে যাতো মা । এক পোয়া সয়াবিন তেল নিয়ে আসিস কাসেমের দোকান থেকে।
উহু! কে শুনতে পেয়েছে মায়ের ডাক। শশীতো কিচ্ছু শুনেনি। শশী তখন ছুট লাগিয়েছে জঙ্গলবাড়ির দিকে ।
ঐখানে ফারজানা ,রিংকি ,পিনু ওরা সবাই বসে আছে।
বৌ বৌ খেলছে।
মা থামাতে না পেরে বোধহয় রেগে গেছে। রাগলে শশীর কী?
দুপুর বেলায় ঝাটা দিয়ে পিটিয়েছিলে কেন, হ্যা?
শশী ব্যথা পায়নি?

জঙ্গলবাড়ি কী অদ্ভুত সুন্দর জায়গা !
আমরা এখানে খেলতে আসি। আমি নীলু, ফারজানা, রিংকী পিনু ।
মাঝে মাঝে ছেলেরা এসে আমাদের খেলা ভেঙে দেয়।
ওরা ক্রিকেট খেলে। ইচ্ছে করে আমাদের খেলা ভাঙতে আসে। কেন বাবা ক্রিকেট খেলার জন্য তোমাদের স্কুলের মাঠ নেই? এখানে আসতে হবে কেন?
আর তো আছেই বড়রা। সবসময় জঙ্গলবাড়িতে আসতে নিষেধ করবে । অথচ এখানে কত কত রঙের ফুলের ঝোপ আছে। রান্নাবাটি খেলার সময় এত্ত এত্ত ফুল পাতা ছিড়ে এত্ত এত্ত শাকসবজি বানানো যায়।
একটা ঢিবিতে বালি আছে। বাড়ির পাঁচিলের ইট খুচিয়ে মরিচহলুদের গুড়া বানান যায় ।
আচ্ছা মরিচ হলুদ গুড়ো ছাড়া রান্না হয়?
অথচ লিয়া পুও সেদিন বলল,”জঙ্গলবাড়িতে খেলতে যাস কেন তোরা? আর কখনো যাবিনা । ঐখানে সাপ বিচ্ছু আছে। নাগ নাগিনী দেখেছিস না সিনেমায় ঐ ওরা থাকে। ধরে নিয়ে গিয়ে সাপ বানিয়ে দেবে!”

ছাই বানাবে! আবীর ভাইয়াকে জিজ্ঞেস করেছি ভাইয়া বলেছে নাগ নাগিনী বলে কিছু নেই।সব লিয়াপুর বানানো কথা। লিয়াপু সেটা শুনে মুখ লাল করে আমাকে বলেছে,”এইসব তুই আবীররাকে বলতে গেলি কেন?”

রেগে গেলে লিয়াপু আবীর ভাইয়াকে আবীররা ডাকে।
আবীর ভাইয়া কলেজে পড়ে। লিয়াপুও কলেজে পড়ে।
আমি শুধু স্কুলে পড়ি। লিয়াপুরা আর আমরা আবীর ভাইয়াদের বাসায় ভাড়া থাকি।

আবীর ভাইয়া আমাকে কাগজ দিয়ে প্লেন বানানো শিখিয়েছে। মন খারাপ হলে কাগজে ইত্তুনি বিত্তুনি আঁকি বুকি করি তারপর ছাদ থেকে আমি প্লেন বানিয়ে ছেড়ে দিই।
জঙ্গলবাড়িতে গিয়ে দেখি ওরা আগেই এসে বসে আছে।
আজকে পিনু বৌ হবে, রিংকী জামাই সাজবে। আমি পিনুর মা। কত্ত কাজ আমার।

রান্নাবান্না করছি। ইশ ভাতে তো লবনটা দেয়া হয়নি।
আর নীলু টা বাজার নিয়ে আসেনা কেন।
ফারজানাটা পিনুকে সাজাচ্ছে ।
“এইযে হীরার চুড়ি পরালাম ,স্বর্ণের টিপ দিলাম কাজল দিলাম ,মুক্তার মালা।”
“আচ্ছা, মেহেদী দিবি না?”
পিনু মন খারাপ করেছে। ফারজানাটা সবসময় মেহেদী লাগাতে ভুলে যায়!
হঠাত্ করেই নীলুর চিত্কার শোনা গেল,”শশী ও শশী তোর মা আসছে । হাতে চিকন বেত আছে।”

আমি শুনেই গাল থেকে বরইয়ের বিঁচি আর হাত থেকে হাড়িডেকচি ফেলে পড়ি কি মরি প্রাণপনে দৌড়
লাগালাম।
দৌড়াতে দৌড়াতে কান দিয়ে ধোঁয়া বেরুচ্ছে ,মায়ের চিৎকার শুনতে পাচ্ছি। একী মা ও দেখি দৌড়াচ্ছে!

“এই জঙ্গলে সাপখোপের মধ্যে কী ? শশী কাছে আয় নচ্ছার আজকে তোর পিঠের চামড়া না তুলেছিতো আমি!”

কে জানত সকালবেলার বৃষ্টিতে জঙ্গলের ভেতর এক হাটু কাঁদা জমেছে। আর মা বুঝি স্কুলের দৌড়প্রতিযোগিতায় রোজ ফার্স্ট হতো?
দুদিন পর্যন্ত শশীর কান দুটো লাল হয়ে ছিল।
আচ্ছা কান টানতেই হবে যখন একটু আস্তে টানলে কী হয় ,হ্যা?

##

লিয়াপুরা ঢাকা চলে যাবে। আমি কত্ত করে বললাম, “ও, লিয়াপু তুমি যেয়োনা। সকালবেলা তুমি হারমোনি না বাজালে আমার ভাল লাগেনা। “
লিয়াপু চোখের চশমাটা মুছতে মুছতে বলেছে, “বাবা সরকারী চাকুরী করেনরে গাধী। না গেলে চলবে?”

আমি লিয়াপুকে জড়িয়ে ধরে ফিসফিস করে বলেছি,”তুমি চলে গেলে আমি কাঁদব। তুমি যেয়োনা!”

লিয়াপুর গায়ে বকুল ফুলের গন্ধ। লিয়াপু চশমা পরে আমার গালে চুমু খেয়ে বলেছে, অনেক কাঁদবি?
আমি হাতের তালুতে চোখ মুছে বললাম, তুমি আমাদের সাথে বউ বউ খেলবে?
লিয়াপু হেসে বলল, “আচ্ছা খেলব । কীভাবে খেলেরে?”
আমি অনেক উত্সাহ নিয়ে বললাম ,তুমি বউ হবা ,আবীর ভাইয়া বর হবে, ভাইয়া …
কথা শেষ হওয়ার আগেই ঠাস করে একটা শব্দ হল। শব্দশুনে আমি হা হয়ে লিয়াপুর দিকে তাকিয়ে রইলাম।
লিয়াপু আমাকে চড় মেরেছে। চড় খেয়ে আমি একছুটে লিয়াপুদের বাসা থেকে বেরিয়ে গেলাম। লিয়াপু আমাকে চড় মেরেছে! আমাকে লিয়াপু চড় মেরেছে! আমি আর কক্ষনো যাবনা ওদের বাসায়! আমাকে মা কত মারে এত জোরে কান্না কখনো পায়নি!

চলে যাওয়ার দিন লিয়াপু আমাদের বাসায় এসেছিল। আমি একটুও সামনে আসতে চাইনি। তখন লিয়াপু ভেতরে এসে জোর করে আমাকে জড়িয়ে ধরল।
হাউমাউ করে কাঁদল।
কাঁদতে কাঁদতে বলল ,”সামনের মাসে আমার বিয়ে হবে শশী। আমি তখন বউ হব। তখন বউ বউ খেলা দেখতে আসিস কেমন ?”

আমি অবাক হয়ে মাথা উঁচু করে লিয়াপুর দিকে তাকিয়ে রইলাম। আমার ঠোঁটে গালে লিয়াপুর চোখের পানি। জিভে নোনতা লাগছিল। লিয়াপুর চশমার কাঁচ ঝাপসা হয়ে গেছে। লিয়াপুর গায়ে একটা বউ বউ গন্ধ!
আচ্ছা বউ হলে বুঝি খুব কাঁদতে হয়?

ভোকাট্টা