ফাগুনপাখির গল্প

পুরো ঘরটা জুড়ে থৈ থৈ করছে বিষন্ন শুন্যতা। শুভর ভেতরটা ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। বিছানায় শুয়ে এপাশ ওপাশ করলো ও কিছুক্ষন। বালিশে মুখ ডুবাতেই মিষ্টি একটা গন্ধ ধাক্কা দিলো নাকে। গন্ধটা খুব পরিচিত, হয়তো কিছুটা আপন ও।

গল্পটা শুরু হয়েছিলো কোন এক পড়ন্ত ফাগুন বিকেলে। মিতুদের উঠোনের কৃষ্ণচূড়া গাছটা ফাগুন বাতাসের মাতাল ছোঁয়ায় রক্তিম হয়ে উঠছিল তখন একটু একটু করে।ভাঙ্গা জানালায় বাসা বেঁধেছে একাকী চড়ুই। তেমনি দিনটাতে মিতু যখন তার নীলসাদা ডায়েরীতে নিবিড় গল্প বোনায় ব্যস্ত শুভ নামের অজানা অচেনা একটা দোপড়া ছেলের সাথে তার বিয়ে তখন পাকা হয়ে গেছে। খুব বেশি ভাবনা ভাবার অবকাশ ছিলোনা মধ্যবিত্ত স্বপ্নগুলোর।মিতুর বাবা ফরিদ সাহেব ভার্সিটি পড়ুয়া মেয়ের ইচ্ছে অনিচ্ছের ধারে কাছ দিয়ে ও গেলেন না। তাছাড়া তার এই মেয়েটি কেমন যেন। তার ভাবালুতায় কালক্ষেপন করার মত বোকামি তিনি করতে পারলেন না। সেদিন বিকেলের ক্লাশ শেষে মিতু যখন মাইলখানেক পথ হেঁটে বাসায় ফিরলো কিছু বুঝে ওঠার আগেই বড় আপা টেনে নিয়ে গেলো তাকে ভেতরের ঘরে। জবড়জং সাজে পরিবেশন করানো হলো তাকে খানিক বাদে ।

ওমা কী কান্ড ! বলতে না বলতেই বিয়ে হয়ে গেলো! দিনটা ছিলো এমনি ফাগুন দিন।
কোথায় গেলো জোড়া শালিক পোষার স্বপ্ন আর ভার্সিটি আসা যাওয়ার পথে মনের ভেতর টুং টাং করে বাজতে থাকা আবোল তাবোল কাব্যকথা।
“আচ্ছা তুমি তো জানতে আমায় তুমি কক্ষনো ভালোবাসবেনা। তাহলে কেনো আমার জোড়াশালিক পোষার স্বপ্নটাকে ভেঙ্গে দিলে ?”
শুভর কাছে এর কী কোনো উত্তর ছিলো আসলে? চিঠিটা ততটুকুতেই ফুরিয়ে গেছে।
শারমিনের শুন্য জায়গাটুকু নিতে অনেক চেষ্টা করেছে মিতু। আর শুভর অন্তিম চেষ্টা ছিলো এক বছর আগে শূন্য হয়ে যাওয়া স্থানটুকু পরম মমতায় আগলে রাখার। এত তাড়াতাড়ি আবার বিয়ে করার ইচ্ছে ছিলোনা ওর। মায়ের হাজার জোরাজুরিতে রাজি হতে বাধ্য হয়েছিলো সে।
“একটা কথা বলি?”
“হু!”
“আমার না খুব উড়তে ইচ্ছে করছে।”
“হু”
“এই দেখো একটা কাগজের প্লেন বানিয়েছি।”
“হু!”
“একটা কথা বলি?”
শুভ একটু বিরক্ত হয়। জবাব দেয়না।
“তুমি আমাকে একটা বাবু দিবা?”
শুভ এবার বেশ অবাক হয়ে বইয়ের উপর থেকে মুখ সরিয়ে মিতুর দিকে তাকায়। ইদানীং বড়ো বেশিই আবোলতাবোল বকতে শুরু করেছে মেয়েটা। দুগালে লাজের আভা, মাথা নত করে বিছানায় আঙ্গুল দিয়ে আঁকিবুকি কাটছে। হা হা করে হেসে ফেলে ও। মিতুর ইচ্ছে করছিলো ঘর থেকে পালিয়ে যায়! এত বেহায়ার মত মানুষ হাসতে পারে?
সেই প্রথম কাছে এসে মিতুর কপাল থেকে চূর্ণ চুলের গোছা আলতো আদরে সরিয়ে দিলো শুভ। লজ্জায় মাথা তুলতে পারছিলোনা মিতু। একটু ম্লান হেসে আবার সরে গেলো শুভ। ডাক্তারি বইটার পাতায় কলমের গুরুত্বপূর্ণ আঁচড় কাঁটতে কাঁটতে আপনমনে বললো, “এক কাজ করো। আবার ভার্সিটি যাওয়া শুরু করো। সারাদিন ঘরে বসে থাকো দেখেই এত একা একা লাগে।”
“একা না ছাই লাগে।” ডায়েরীর পাতায় মিতুর সেদিনকার লেখা। একটা বাবু থাকলে ইচ্ছেমত কাগজের প্লেন বানিয়ে ওর সাথে খেলতাম। তোমার মতো ভ্যাবদা মাছ বানাতাম না ওটাকে। সারাদিন নাকের ডগায় বিশ্রী চশমা ঝুলিয়ে কী যে পড়ো তুমি। আমার বাবুকে আমি জেলে বানাব। নৌকায় করে বৌকে নিয়ে মাঝদরিয়া পাড়ি দেবে।ওসব ছাইপাশ ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার হতে দেবনা। খামাখা বৌটা কষ্ট পাবে।”
দিনগুলো কীভাবে যেন কেটে যাচ্ছিলো। সারাদিন ডিউটি চেম্বার পড়াশোনা সবশেষে মাঝরাতে ক্লান্ত শ্রান্ত হয়ে গা এলিয়ে ঘুমুনোর আয়োজন। শুভ কী বুঝতে পারছিলো তার নিরবচ্ছিন্ন অবহেলায় এক মানবী হৃদয়ে অশ্রুত রক্তক্ষরণ হচ্ছিলো দিবানিশি। মিতু চাইলেই জোর করে তার সবটুকু অধিকার ছিনিয়ে নিতে পারতো। সে তেমন প্রকৃতির মেয়ে ছিলোনা মোটে ও। বরং একটু বেশিই অভিমানী আর সহজ সরল ছিলো।
সেদিন মাঝরাতে জোরালো বৃষ্টির শব্দে ঘুম ভেঙ্গে যায় শুভর। জানালার পাল্লা মেলে বাইরে তাকিয়ে আছে মিতু। দমকা বাতাসে চুল উড়ছে , বৃষ্টির ছাটে ভিজে যাচ্ছে টেবিলের উপর রাখা শুভর জরুরী বইপত্র। একটু বিরক্তি নিয়েই উঠে পড়ে ও।
“এই মেয়ে এভাবে দাড়িয়ে আছো কেনো?”
“মাকে খুব মনে পড়ছে।”
শুভ একটু চুপ হয়ে যায়। মিতুর মা মারা গেছেন বছরখানেক আগে।
হঠাত্‍ মিতুর ভেজা কন্ঠ ছাপিয়ে উঠলো অস্ফুট স্বরে….্
“এই শহরের আকাশটাতে মেঘ জমেছে,
পাথর পাথর মানুষগুলোর মন গলেছে,
শব্দ ঠোঁটে পথ ভুলেছে সুর তুলেছে,
অবাক চোখে জল নেমেছে, জল নেমেছে।”
শুভ কী ভেবে একটু হাসে।
“তারপর?”
“নিঃস্ব শহর খুব আঘাতে খুব সয়েছে,
রৌদ্রে পুড়ে জল শুকিয়ে কাঠ হয়েছে,
একলা পথে একলা শালিক খুব ছুটেছে
পায়ের নিচে তপ্ত বালির খই ফুটেছে।
অবাক চোখে জল নেমেছে, জল নেমেছে।”
শুভ মুগ্ধ হয়ে শোনে। মিতুর চোখে ও জল জমেছিলো সেদিন।অবোধ একটা কান্নার তোড় সামলে নিচ্ছিলো সে খুব কষ্টে। আর শুভর বুকে কী একটা ভীষন মমতা জন্ম নিলো হঠাত্‍। কিছু বুঝে ওঠার আগেই মিতু আবিষ্কার করলো কী ভীষন আপন দুটি হাত তাকে পরম মমতায় জড়িয়ে নিচ্ছে।
তারপর আবার একটা এলোমেলো ফাগুন আসি আসি করতে থাকে। ভীষন ব্যস্ত শুভ ভুলে যায় সবকিছু। এটুকু জানার অবসর মেলেনা ওর, সেদিনের সেই ক্ষনিক ভালোবাসা একটা নতুন অস্তিত্ব নিয়ে কত নিবিড়ভাবে বড় হতে শুরু করেছে মিতুর ভেতর। কেনো মিতুকে সে উপেক্ষা করে তা সে নিজেই জানেনা। শারমিন আর সে ভালোবেসে যে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়েছিল সেই পথ নতুন সঙ্গি হিসেবে মিতুকে মেনে নিতে চায়নি বলেই হয়তো।
“জানো, উঠোনের কাঁঠালগাছটার তলায় একটা ডানাভাঙ্গা পাখিকে পড়ে থাকতে দেখেছি আজ।”
“এত কিছু দেখতে তোমাকে কে বলেছে?”
শুভ একটু বিরক্ত হয়ে পাশ ফেরে।
“তুমি রাগ করলে? রাগ কোরোনা। তুমি রাগলে আমার খুব খারাপ লাগে। চা খাবে ?”
শুভর একটু জ্বর জ্বর লাগছিলো, মাথায় তীব্র ব্যথা।
এই মেয়েটা এত প্যানপ্যান করে কথা বলে কেনো?
“রাত কটা বাজে মিতু খেয়াল আছে? আমাকে একটু ঘুমুতে দিবে প্লীজ।”
মিতু বিড়বিড় করে যায় তাও।
“জানো যখন খুব জোরে বৃষ্টি শুরু হলো ডানাভাঙ্গা পাখিটার সঙ্গী পাখিটা চলে যেতে যেতে বারবার ফিরে ফিরে আসছিলো। আর কাঁদছিলো খুব দুজন। আমি এখান থেকে শুনতে পাচ্ছিলাম। আজ বৃষ্টি হওয়ার কী অমন দরকার ছিলো।”
“তুমি ঘুমোলে? মা আজ বকেছে আমি বৃষ্টিতে ভিজেছি তাই। বলে বাবুর নাকি ক্ষতি হবে। কিন্তু জানো বাবু আর আমি খুব মজা করে বৃষ্টিতে ভিজেছি।”
“উফ মিতু। আমার মাথা ধরে গেলো।”
মিতু চুপ হয়ে যায়। তার কেমন একটা কষ্ট হচ্ছে। ডানা ভাঙা পাখিটার বুকে টিক ঠিক যতখানি কষ্ট জমেছিল।
কিছু টুকরো কাগজে কয়েকটা লাইন চিঠি আর এলোমেলো সব কবিতা। আবার সেই প্রথম ফাগুন দিনটা শুন্যতা নিয়ে আলতো পায়ে দরজায় উঁকি দেয়। ঘরটা জুড়ে এখনো মিতুর ছায়া। শুভ নস্টালজিয়ায় ভোগে।বারবার করে লেখাগুলোর গন্ধ শোঁকে ও। ডায়েরীর ভাজে ভাজে শুকনো ফুল। কবে যেন শুভ মিতুর খোঁপায় মালা জড়িয়ে দিয়েছিলো। পাগলী মেয়েটা জমিয়ে রেখে দিয়েছিলো সেই কুড়িয়ে পাওয়া ভালোবাসার স্পর্শটুকু। নীলসাদা ডায়েরীর শেষপাতায় একটা কবিতায় মিতুর অশ্রুচিহ্ন। লেপ্টে আছে কালি এখানে সেখানে …
ফাগুন ফাগুন গন্ধ ঠোঁটে
কষ্টে ভারী চোখ,
তোমার চোখের অশ্র ফাগুন
শুধুই আমার হোক।
ফাগুন তুমি একান্তে যার
শুধুই অভিমান,
বিকেল বিকেল আকাশটাতে
সব হারানোর গান।
একলা ফাগুন গল্প বলে
নষ্ট প্রেমের এক,
চোখের কোনে পাপড়ি মেলে
কৃষ্ণচূড়ার মেঘ।
‘চোখের কোনে পাপড়ি মেলে … … ‘
শুভর চোখে জ্বালা করে ওঠে ।
বুবুন আসার আগের দিনটাতে মিতু কী বুঝতে পেরেছিলো সে এমনি করে হারিয়ে যাবে আর নিছক একটা গল্পের ফ্রেমে শুভর সকাল সন্ধ্যা রাত্রিদিন বন্দী করে রেখে যাবে?
“এক ফাগুনের গল্প কথা
সেই ফাগুনেই শেষ,
সন্ধ্যে নামা বারান্দাতে
মেঘবালিকার কেশ।
ফাগুন আমার একলা ফাগুন
কাজল কাজল ভোর
আমি যদি হাত ছেড়ে দিই
কষ্ট হবে তোর?”

জানালা দিয়ে উঁকি মারে এক টুকরো নিঃস্ব ফাগুন আকাশ। বসন্ত শুরুর মাতোয়ারা উত্‍সব বাহির বারান্দায় মিতুর প্রিয় প্রকৃতি জুড়ে। সেখানে শিমুল ডাল এলোমেলো বাতাসে মাথা দোলায় আর কোকিল কন্ঠে ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হয় তীব্র সুরে কিছু একটা নেই হয়ে যাওয়ার আর্তনাদ।
বিকেলের চূর্ণবিচূর্ণ রোদ জানালা গলিয়ে শুভর মুখে এসে পড়েছে।
“বাবা তুমি দাও নাই তেম্বারে?”
“ওরে ওরে তুমি ঘুমাওনি দুষ্টু ছেলেটা? নাকি বাবা তোমার ঘুম ভাঙিয়ে দিলাম?”
বুবুন গোলাপ গোলাপ ঠোঁট বাঁকিয়ে একটা অপূর্ব হাসি উপহার দেয়। শুভর ভেতরটা মোচড় দিয়ে ওঠে আবার।
শুভ ব্যস্ত ছিলো অপারেশন থিয়েটারে একটা গুরুত্বপূর্ণ সার্জারিতে। বাসা থেকে অসংখ্যবার ফোন আসছিলো। ধরার উপায় ছিলোনা। মুঠোফোনে মিতুর শেষ মেসেজ।
…”মা হসপিটালে নিয়ে এলো। খুব ব্যথা হচ্ছে,কষ্ট পাচ্ছি খুব। অস্থির লাগছে কেনো এত? তোমাকে একটু শুনবো।তোমাকে একটু দেখব। আসবা না?”..
না দেখা হয়নি আর।
“একলা পথে এমনি করে
খুব পুরাতন গল্প জমে,
শুষ্ক চোখের জলসীমানায়
ইচ্ছে মতন বৃষ্টি নামে! “

বুবুন প্রায় বাবার বুকে চড়ে বসে। বাবার বুক থেকে মুখ তুলে তাকায়।খুব ভালো লাগছে ওর। প্রতিবছর প্রথম ফাগুনের দিনটাতে বুবুনকে নিয়ে ঘুরতে বেরোয় শুভ। গত চারবছর ধরেই। বুবুনের জন্মদিন বলেই কী শুধু?
কে যেন তীব্র দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে শুভর ভেতরটায়।
একটু একটু করে রং পাল্টাচ্ছে আর গোধূলীর ছায়া ঘন রঙে ঢেকে যাচ্ছে আকাশটা। বারান্দায় কিচিরমিচির রবে গল্পের খই ফোটাচ্ছে জোড়া শালিক।
বুবুন জানালা দিয়ে দেখতে পেয়ে ছুটে আসে আর রিনরিনে কন্ঠে চিত্‍কার করে ওঠে।
“বাবা দেখোনা। দুইতা পাখি ও বাবা।”
শুভ কাছে এসে বুবুনকে কোলে তুলে নেয়। ছেলেটা হয়েছে ঠিক ওর মায়ের মত।
বাবার শার্টের কলারের কাছটা ছোট মুঠিতে শক্ত করে চেপে ধরে বুবুন।
“এতা কী পাখি বাবা? কী সুন্দর ! বাবা বাবা …”
হাততালি দিতে দিতে শুভর কোল থেকে লাফ মারতে চায় বুবুন। পারেনা। বাড়ী গেলে দাদু যেমন তৈ তৈ করে হাঁসকে ডাকে তেমনি করে সেও ডাকতে থাকে।
“আয় তৈ তৈ ,আয় তৈ তৈ…”
চঞ্চল বুবুনকে শক্ত করে বুকে জড়িয়ে রাখে শুভ। আর আনমনা হয়ে তাকিয়ে থাকে পাখি দুটোর দিকে। তার ঠিক মনে হয় সেই ডানা ভাঙ্গা ফাগুনপাখিটা আবার জোড়া শালিক হয়ে বাসা বাঁধতে এসেছে বেলা শেষে খুঁজে পাওয়া খড়কুটোর সেই ছোট্ট বাসায়।

ফাগুনপাখির গল্প